১৯৭১ সালের মার্চ। ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ। রাজশাহীতে নিজের বাড়িতেই কাটছে জাফরুল ইসলামের সময়। পত্রপত্রিকায় সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির খবর পাচ্ছেন। ৭ মার্চ ঢাকায় ঐতিহাসিক সমাবেশ হয়েছে। সেই খবর জানতে উন্মুখ জাফরুল। রাজশাহীতে তখন এক দিন পরে পরে পত্রিকা আসত। ৯ মার্চ পত্রিকা পড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের বিবরণের পাশাপাশি জানতে পারলেন ঢাকায় বাংলাদেশের পতাকা তোলার খবর। পতাকার ছবিও ছাপা হয়েছে।
২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস পালন করে সরকার। এই দিনেই প্রতিবাদস্বরূপ কিছু একটা করা দরকার, ভাবলেন জাফরুল ইসলাম। এই ভাবনা থেকেই পতাকা উত্তোলনের কথাটা মাথায় এল। শুরু হলো পতাকা বানানোর তোড়জোড়। কিন্তু শুরুতেই বিপত্তি। পতাকার রং কী হবে? পত্রিকার সাদা–কালো ছবি দেখে তো বোঝার উপায় নেই পতাকার কোন অংশের কী রং। জাফরুলের চাচা শামসুল আবেদীন ঢাকায় ব্যাংকে চাকরি করতেন। ভাবলেন চাচা নিশ্চয়ই বলতে পারবেন। রাজশাহী থেকে ঢাকায় তখন সরাসরি ফোন করা যেত না। ট্রাঙ্ক কল করতে হতো। এভাবে তিনি চাচার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তাঁর চাচা খোঁজ নিয়ে জানালেন—সবুজ বাংলার জমিনের ওপরে লাল সূর্য, তার মাঝখানে সোনালি রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র।
এক দিনের মধ্যেই সবুজ আর লাল কাপড় জোগাড় করে ফেললেন জাফরুল ইসলাম। কিন্তু বিপত্তি ঘটাল সোনালি কাপড়। অনেক খোঁজ করেও কোথাও পাওয়া গেল না এই রঙের কাপড়। বাড়িতে ফিরে মাকে আশাভঙ্গের কথা জানালেন। মা-ই তখন স্যুটকেস থেকে নিজের বিয়ের ব্লাউজটা বের করে দিলেন। ব্লাউজের রং ছিল সোনালি। জীবনে হয়তো একবারই পরেছিলেন। তারপর মধুর স্মৃতি হিসেবে তুলে রেখেছিলেন। বাড়িতে হাতমেশিন ছিল। রাতেই কাপড় কেটে সেলাই করে পতাকা বানালেন মা-ছেলে। বাংলাদেশের পতাকা।
রাজশাহীর কুমারপাড়া এলাকায় নিজের বাড়িতে ২৩ মার্চ সকাল সাড়ে ছয়টায় পতাকাটি উত্তোলন করলেন জাফরুল। সারা দিন উড়ল সেই পতাকা। সন্ধ্যায় আবার নামিয়ে ফেললেন। এতেই খবর পেয়ে গেল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বাড়িটি পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলো। নিরাপত্তার কথা ভেবে যুদ্ধের সময় রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বালাসি গ্রামের আত্মগোপন করলেন তাঁরা। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও রাজশাহীতে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবেশ করেন ১৭ ডিসেম্বর। ওই দিনই বাড়ি ফিরে আবার পতাকাটি তোলেন জাফরুল ইসলাম। তারপর অনেক দিন পর্যন্ত তোলা ছিল।
রাজশাহীর পিএন (বর্তমানে বালিকা) উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন জাফরুল ইসলাম। তাঁর মা রুবী ইসলামও একই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশে–বিদেশে কে কোথায় আছেন, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও ছবি দিয়ে বিদ্যালয়ের একটি কক্ষকে জাদুঘরের মতো করে সাজিয়েছেন। সেখানে তাঁর মায়ের ছবিও আছে। আর আছে মায়ের ব্লাউজ কেটে পতাকা তৈরির সেই কাহিনি।
২০১৫ সালে প্রায় ৭৭ বছর বয়সে মারা যান রুবী ইসলাম। জাফরুল ইসলাম যুক্তরাজ্যের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাডাম স্মিথ ইন্টারন্যাশনাল ইউকে’র পলিসি অ্যাডভাইজার হয়েছিলেন। বর্তমানে ঢাকায় অবসরজীবন কাটাচ্ছেন। সড়ক সম্প্রসারণের কারণে তাঁদের সেই বাড়িটিও ভাঙা পড়েছে।
আর সেই পতাকা? জাফরুল ইসলাম জানালেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার জন্য যখন যুদ্ধ সময়ের বিভিন্ন স্মারক সংগ্রহ করা হচ্ছিল, তখন তিনি এটি সেখানে জমা দিয়েছিলেন। জাফরুল ইসলাম বলেন, ‘সেই পতাকার ঘ্রাণ নিলে আজও আমার জননীকে খুঁজে পাই। তাই মহান স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় যাই। পতাকাটির দিকে তাকিয়ে থাকি, অজান্তেই চোখ ভিজে যায়।’
0 Comments