Wednesday, April 3, 2024

যৌন হয়রানি ঠেকানোর পথে বাধা দুর্বল আইনি কাঠামো

 

যৌন হয়রানির বিচার না পাওয়ায় আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। সম্প্রতি এ রকম একটি ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা লাল কার্ড প্রদর্শন করেনছবি: দীপু মালাকার

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আমাদের আইনি কাঠামো খুবই দুর্বল। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে একাধিক আইন থাকলেও সেই আইনগুলোয় ‘যৌন হয়রানি’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। শুধু ২০০৯ সালে করা একটি জনস্বার্থে মামলার রায়ে উচ্চ আদালত শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন, যাতে বলা হয়েছিল, আইন না হওয়া পর্যন্ত এই নির্দেশনাগুলোকে কর্তৃপক্ষ মানতে বাধ্য থাকবে।

এই নির্দেশনায় যেমন বলা হয়েছে, যৌন হয়রানির অভিযোগ তদন্ত করতে প্রতিটি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগ কমিটি গঠন করতে হবে, তেমনি জোর দেওয়া হয়েছে প্রতিরোধমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার ওপরও। তবে গত এক দশকে অভিযোগ কমিটি গঠনের বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে কিছুটা গুরুত্ব পেলেও, উপেক্ষিত রয়ে গেছে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধানগুলো।

যেমন উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় স্পষ্ট বলা হয়েছে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নতুন সেশনের ক্লাস শুরু হওয়ার আগে একটি বাধ্যতামূলক ওরিয়েন্টেশন ক্লাস নিতে হবে, যেখানে জেন্ডার বৈষম্য ও যৌন হয়রানির বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের সবার জন্য এ রকম সচেতনতামূলক নিয়মিত প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রতি মাসে একবার অথবা প্রতি ছয় মাসে অন্তত একবার। সরকারি পর্যায়ে সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য চাওয়া প্রয়োজন, এই ওরিয়েন্টেশন ও প্রশিক্ষণের ব্যাপারে তারা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে এ পর্যন্ত কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে।

আদালতের নির্দেশে আরও বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব থাকবে যৌন হয়রানি ও অন্যান্য যৌন অপরাধের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বিধিবিধানসহ দেশের যেসব প্রচলিত আইন রয়েছে, তা বুকলেট আকারে প্রকাশ করা এবং এ-সংক্রান্ত তথ্য শিক্ষার্থীদের কাছে সহজবোধ্য ভাষায় পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু এ নির্দেশনার কোনো প্রয়োগ বাস্তবে দেখা যায় না।

যৌন হয়রানির বেশির ভাগ ঘটনাই যে অভিযোগ পর্যন্ত গড়ায় না তার অন্যতম একটি কারণ হলো, শিক্ষার্থীদের কাছে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নীতিমালা ও এ-সংক্রান্ত আইনি নিয়মগুলো স্পষ্ট নয়। এছাড়া এ ব্যাপারে তথ্য পাওয়াও সহজ নয়। একটি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি কমিটিতে কারা আছেন, কমিটিতে কীভাবে অভিযোগ করতে হবে, অভিযোগ করলে গোপনীয়তার সুরক্ষা হবে কি না? ভবিষ্যতে কোনো প্রতিশোধমূলক আচরণের শিকার হলে সুরক্ষার কী বিধান আছে? এসব বিষয়ে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে প্রতিষ্ঠানের সবাইকে।

আদালতের নির্দেশনা বলছে যে সরাসরি অভিযোগ কমিটির কাছে ‘মেইল’-এর মাধ্যমেও একজন অভিযোগকারী অভিযোগ জানাতে পারেন। আবার অভিযোগকারী চাইলে কমিটির যেকোনো একজন নারী সদস্যকে আলাদাভাবেও অভিযোগ জানাতে পারেন। অর্থাৎ কমিটির সদস্য কারা এবং তাঁদের সঙ্গে সরাসরি অভিযোগ জানানোর কী কী মাধ্যম রয়েছে, সেসব বিষয় নিয়ে স্পষ্ট তথ্য থাকতে হবে, নির্দেশনাও বলা হয়েছে।

আরও পড়ুন

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দেখা গেছে, গত দুই বছরে অভিযোগ এসেছে কোথাও মাত্র তিনটি, কোথাও পাঁচটি বা ছয়টি। প্রতিষ্ঠানের পরিধি আর শিক্ষার্থীর সংখ্যা তুলনা করলে সংখ্যাটি যে সেই প্রতিষ্ঠানের যৌন হয়রানির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরছে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একাধিক বিভাগ থাকলেও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একটিমাত্র অভিযোগ কমিটি থাকে। অনেক শিক্ষার্থীর কাছেই যৌন হয়রানির মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পৌঁছানো জটিল প্রক্রিয়া মনে হতে পারে। এ কারণে দেখা যায় হয়রানির মাত্রা চরম হলেই সাধারণত কেউ আনুষ্ঠানিক অভিযোগের পথ বেছে নেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিভাগ অনুযায়ী একাধিক কমিটি গঠন করা যায় কি না, সে বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন হয়রানিমূলক আচরণ কী সেই বিষয়েও সংবেদনশীল, উন্মুক্ত এবং নিরপেক্ষ আলোচনা আর সংলাপের প্রয়োজন আছে। যৌন হয়রানি অপরাধটি বাংলাদেশের কোনো আইনেই সংজ্ঞায়িত করা নেই। এমনকি ২০০৯ সালের উচ্চ আদালতের যে নির্দেশনাটি রয়েছে সেখানেও যৌন হয়রানিকে সংজ্ঞায়িত করতে শুধুমাত্র যৌন হয়রানিমূলক আচরণের কিছু উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে সার্বিকভাবে যৌন হয়রানি বিষয়ে একটি অস্পষ্টতা রয়ে গেছে।

অনেক ক্ষেত্রে কিছু হয়রানিমূলক আচরণ এতটাই গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায় যে হয়রানির শিকার ব্যক্তিও একসময় মনে করেন যে বিষয়টি তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত এবং কর্তৃপক্ষের কোনো প্রতিকার দেওয়ার সুযোগ নেই। এ কারণেই কোন আচরণগুলি যৌন হয়রানিমূলক হবে সেই ব্যাপারেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। অন্তত ২০০৯ সালের আদালতের নির্দেশনায় যৌন হয়রানিমূলক আচরণকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যেসব উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, সেই বিষয়গুলোও জানানো যেতে পারে।

যেমন ২০০৯ সালের নির্দেশনা অনুযায়ী ক্লাসের বেঞ্চে লিখে রাখা কোন যৌন ইঙ্গিতময় শব্দ বা চিত্র অথবা অনুপযুক্ত কোন মোবাইল বার্তাও যে যৌন হয়রানিমূলক হতে পারে এবং আইনত এই ধরনের আচরণের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করার সুযোগ আছে— এই বিষয়গুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব সদস্যদেরই অবগত থাকা প্রয়োজন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির অভিযোগ তদন্তের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণের বিষয়টিকেও নজরে আনতে হবে। উচ্চ আদালতে নির্দেশনায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, কমিটি অভিযোগের তদন্ত শেষ করে কর্তৃপক্ষকে তাদের সুপারিশ জানাবে ৩০ দিনের মধ্যে। এটা প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ৬০ দিন পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে।

কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোয় উঠে এসেছে অনেক ক্ষেত্রেই এই সময়সীমার মধ্যে কমিটির রিপোর্ট প্রদান করতে পারে না। আবার কমিটি অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তির সুপারিশ করলেও প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব শৃঙ্খলামূলক বিধিবিধান মেনে সেই সুপারিশ কার্যকর করতে আরও দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে যায়।

গত কয়েক দিনের গণমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোয় উঠে এসেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগ পাওয়ার পর অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা যাচাই করা হয় একটি অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান কমিটি গঠনের মাধ্যমে। কিন্তু ২০০৯-এর নির্দেশনা অনুযায়ী, একজন অভিযোগকারী সরাসরি কমিটির কাছেই অভিযোগ জানাবেন এবং সেই অভিযোগের ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হবে।

অভিযোগের তদন্ত যাতে পক্ষপাতদুষ্ট না হয়, সে কারণেই ২০০৯-এর নির্দেশনায় রয়েছে যে কমিটিতে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে অন্ততপক্ষে দুজন বহিস্থ সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ আরেকটি কমিটির মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে অভিযোগ যাচাই করা হয়, সেখানে যদি প্রতিষ্ঠানের বাইরের সদস্য অনুপস্থিত থাকেন, সে ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার শর্তটি অকার্যকর হয়ে যেতে পারে।

আবার প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব শৃঙ্খলা সম্পর্কিত বিধি-বিধান এর সঙ্গে যৌন হয়রানির নীতিমালাকে সমন্বয় করতে হবে। এটা করতে না পারলে অনেক সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির আপিলে যৌন হয়রানি কমিটির সিদ্ধান্ত উচ্চ আদালতে বাতিল হয়ে যেতে পারে। এ কারণে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ২০০৯-এর নির্দেশনার আলোকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এর ফলে একটি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির অভিযোগ তদন্তের প্রক্রিয়া কেমন হবে এবং প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান অন্যান্য শৃঙ্খলামূলক বিধির সঙ্গে তা কীভাবে সমন্বয় করা হবে, তা সুস্পষ্ট করা যাবে।

একটি প্রতিষ্ঠান তার দায়িত্ব পালন করছে কি না, সেটি দেখার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জবাবদিহিমূলক তত্ত্বাবধানের কাঠামো তৈরি করতে হবে। ২০০৯-এর নির্দেশে বলা হয়েছে, এই নির্দেশনার প্রতিপালনের চিত্র তুলে ধরে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে গঠিত কমিটি সরকারকে একটি বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দেবে।

কিন্তু সরকারের কোন দপ্তরে এই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে, কী থাকবে প্রতিবেদনে আর কীভাবে সেই প্রতিবেদন মূল্যায়ন করা হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনায় কিছু বলা নেই। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি আইন অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়ন না করে বা যৌন হয়রানি প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের পদক্ষেপগুলো না নেয়, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে সেই বিষয়টিতেও সুস্পষ্ট বিধান থাকতে হবে।

রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য তাই একটি আইনগত তত্ত্বাবধানের কাঠামোর প্রয়োজন আছে। আর এ কারণেই অনেক বছর ধরেই বিভিন্ন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি আলাদা আইনের দাবি করে আসছে। যৌন হয়রানি রোধে এই পৃথক আইন কতটা কার্যকর হতে পারে এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে কী ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে, তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি মেয়েকে স্কুল-কলেজের গণ্ডি পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসতে পারিবারিক, অর্থনৈতিক এবং আরো অনেক সামাজিক বাধা পার হতে হয়। সেই মেয়েটি নিরাপত্তার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝরে যাবে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে তার সামাজিক উন্নয়নের অগ্রাধিকার তালিকায় নারী ও শিশুশিক্ষার গুরুত্বকে স্থান দিয়েছে। একইভাবে এখন নারী ও শিশুর নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টিকেও অগ্রাধিকার দেওয়া অতি জরুরি। নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ এখন সময়ের দাবি।


সোমালিয়ায় জিম্মি ২৩ নাবিকের মুক্তি নিয়ে সর্বশেষ যা জানা গেল


সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশের জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিকের মুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছেফাইল ছবি

জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার পর ২৩ দিন পেরিয়ে গেছে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ২৩ নাবিকের। দস্যুদের সঙ্গে সমঝোতা কখন চূড়ান্ত হবে, নাবিকেরা কখন মুক্তি পাচ্ছেন—এ নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। তবে জাহাজের মালিকপক্ষ, নৌপ্রশাসন ও নাবিকদের স্বার্থরক্ষাকারী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সর্বশেষ তথ্য হলো, এখন পর্যন্ত দস্যুদের সঙ্গে চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি। তবে নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে দস্যুদের সঙ্গে সমঝোতার প্রক্রিয়া বেশ অনেকটা এগিয়েছে।

১২ মার্চ ভারত মহাসাগর থেকে ২৩ নাবিকসহ এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ জিম্মি করে সোমালিয়ার দস্যুরা। এরপর জাহাজটির দুই দফা অবস্থান পরিবর্তন করে সোমালিয়ার গদভজিরান জেলার জেফল উপকূলে নিয়ে যায় দস্যুরা। জিম্মি করার ৯ দিনের মাথায় জাহাজ থেকে মালিকপক্ষের সঙ্গে স্যাটেলাইট ফোনে যোগাযোগ করে দস্যুরা। মূলত জাহাজসহ নাবিকদের মুক্তির বিষয় নিয়ে এরপরই আলোচনা শুরু হয় দুই পক্ষের মধ্যে।

এমভি আবদুল্লাহ জিম্মি হওয়ার পর থেকে নৌপরিবহন অধিদপ্তর বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর রাখছে। জানতে চাইলে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, সমঝোতা নিয়ে আগে দুই পক্ষের (জাহাজমালিক ও দস্যু) যে দূরত্ব ছিল, তা এখন কমে এসেছে। এটুকু বলা যায়, জাহাজসহ নাবিকদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে অগ্রগতি বেশ ভালো।

দস্যুরা সাধারণত বড় অঙ্কের মুক্তিপণের দাবি নিয়েই আলোচনা শুরু করে জিম্মি জাহাজের মালিকের সঙ্গে। মুক্তিপণের অঙ্ক সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে দর–কষাকষি করে মালিকপক্ষ। এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে কত মুক্তিপণ দাবি করেছে দস্যুরা তা জানা যায়নি। মালিকপক্ষ কখনোই বিষয়টি স্বীকার করে না। ২০১০ সালে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি জাহান মণি প্রায় চার মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল বলে সে সময় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল। তবে মালিকপক্ষ জাহান মণি জাহাজ ফিরিয়ে আনতে কত মুক্তিপণ পরিশোধ করেছে তা এখন পর্যন্ত স্বীকার করেনি।

মালিকপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জিম্মি নাবিকসহ এমভি আবদুল্লাহ মুক্ত করতে এখনো আলোচনা চলছে। সমঝোতাও চূড়ান্ত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে জাহাজের মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে এখনো চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি। তবে আলোচনার অগ্রগতি হচ্ছে।  

অভিজ্ঞ দুজন নাবিক প্রথম আলোকে জানান, সমঝোতা হলেও নাবিকদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সময় লাগবে। কারণ, সমঝোতার পরের ধাপ হচ্ছে দস্যুদের হাতে অর্থ পৌঁছানো। দস্যুরা মুক্তিপণের অঙ্ক ডলারে নগদ নেয়। কারণ, ব্যাংকব্যবস্থায় এই অর্থ নেওয়া হলে তা আটকে যেতে পারে। আর নগদ ডলার পৌঁছে দিতে হয় জিম্মি জাহাজের আশপাশে সাগরে দস্যুদের নির্ধারিত স্থানে।

মুক্তিপণের অঙ্ক কীভাবে দস্যুদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়, তা জানা যায় ২০১০ সালে জিম্মি হওয়া এমভি জাহান মণি জাহাজ মুক্ত করার ঘটনায়। সেই সময়ে এমভি জাহান মণি জাহাজের নাবিকসহ যে ২৬ জনকে সোমালিয়ার দস্যুরা জিম্মি করেছিল, তার একজন ছিলেন মোহাম্মদ ইদ্রিস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হেলিকপ্টার থেকে দুটি পানিরোধী কার্টন সাগরে ফেলা হয়েছিল। দস্যুরা নৌযান নিয়ে প্যাকেট দুটি জাহাজে নিয়ে আসে। পরদিনই ভোরে দস্যুরা জাহাজটি থেকে নেমে যায়। আমরাও ওই জায়গার কাছাকাছি ওমানের সালালা বন্দরের পথে রওনা হই।’  

মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সমঝোতার পর বাংলাদেশ থেকে নতুন নাবিকদের একটি দল প্রস্তুত রাখা হবে। জিম্মি জাহাজটি যে দেশের বন্দরে প্রথম পৌঁছাবে, নতুন নাবিকদের সেই দেশের ভিসার জন্য আবেদন করা হবে। আবার জিম্মি জাহাজের নাবিকদেরও ওই দেশের বন্দর হয়ে দেশে ফেরার জন্য ভিসা দরকার হবে। এসব প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি বলে মালিকপক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে।      

সমঝোতা চূড়ান্ত হওয়ার পরও জাহাজটি কাছাকাছি বন্দরে নেওয়া পর্যন্ত এক থেকে দুই সপ্তাহ সময় লাগতে পারে বলে মনে করেন নাবিকদের স্বার্থ সুরক্ষাকারী সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী। তিনি বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, সমঝোতার পর মুক্তিপণ পরিশোধ, জাহাজটি কাছাকাছি নিরাপদ বন্দরে নেওয়া পর্যন্ত অনেকগুলো প্রক্রিয়া রয়েছে। তবে এখন যেভাবে আলোচনা এগোচ্ছে, তাতে জাহান মণি জাহাজের চেয়ে কম সময়ে এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের নাবিকদের মুক্তি মিলতে পারে। যদিও দস্যুদের ওপর মূলত নির্ভর করছে কখন ফিরতে পারবেন জিম্মি নাবিকেরা।

 

Tuesday, April 2, 2024

শিশুকে ধর্ষণের পর লাশ গুম করে নিখোঁজের মাইকিং করা আসামির মৃত্যুদণ্ড

 


কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে এক শিশুকে হত্যার মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া আসামি মোহাম্মদ আলী। আজ মঙ্গলবার দুপুরে কুমিল্লা আদালত থেকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়ার সময়ছবি: প্রথম আলো

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ কাঁথায় মুড়িয়ে ডাকাতিয়া নদীতে ফেলার দায়ে মোহাম্মদ আলী ওরফে বাপ্পী (২৬) নামের এক যুবককে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আজ মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কুমিল্লার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১–এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন এ রায় দেন। রায় ঘোষণার সময় আদালতের কাঠগড়ায় ছিলেন মোহাম্মদ আলী।

মামলার বিবরণে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ বেলা সাড়ে তিনটার দিকে বিদ্যালয়পড়ুয়া ওই শিশুকে তেঁতুল খাওয়ানোর কথা বলে মোহাম্মদ আলী একটি চৌচালা টিনের ঘরে নিয়ে যান। এরপর তিনি শিশুটিকে ধর্ষণ করে হত্যার পর লাশ কাঁথা দিয়ে মুড়িয়ে ডাকাতিয়া নদীতে ফেলে দেন। এ ঘটনার পর তিনি নিজে থেকে অটোরিকশা ভাড়া করে এনে শিশুটির নিখোঁজের সংবাদ মাইকিং করেন। একপর্যায়ে এলাকাবাসীর সন্দেহ হয়। পরে পিটুনি দিলে তিনি শিশুটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ গুমের কথা স্বীকার করেন। এ ঘটনায় শিশুটির বাবা পরদিন চৌদ্দগ্রাম থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করেন। মামলায় মোহাম্মদ আলীকে একমাত্র আসামি করা হয়।

২০১৯ সালের ২ জুন মোহাম্মদ আলী ও একই গ্রামের মো. মিজানের (২২) নামে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চৌদ্দগ্রাম থানার উপপরিদর্শক ইকবাল মনির। ২০২০ সালের ৮ মার্চ এই মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়। এরপর মামলায় ১০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। আজ আদালত মোহাম্মদ আলীকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেন। অপর আসামি মো. মিজানকে বেকসুর খালাস দেন বিচারক।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে শিশুটির বাবা বলেন, ‘এ রায়ে আমি খুশি। দ্রুত ফাঁসির আদেশ কার্যকর দেখতে চাই। আমার অবুঝ শিশুর মুখে ও গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য ঘাড় মটকিয়ে দেওয়া হয়। পরে কাঁথা মুড়িয়ে লাশ বাড়ির পাশের ডাকাতিয়া নদীতে ভাসিয়ে দেয় মোহাম্মদ আলী। একসঙ্গে এতগুলো অপরাধ করা ব্যক্তির ফাঁসি দ্রুত হলে আমি শান্তি পাব।’

কুমিল্লা আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, রায়ের দ্রুত কার্যকর চান তাঁরা। অবুঝ শিশুর ওপর নির্মম নির্যাতন করেছেন মোহাম্মদ আলী। এই রায় ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, রায়ে বিবাদী পক্ষ খুবই অসন্তুষ্ট। রায়ের কপি পাওয়ার পর আপিল করবেন তাঁরা।

Sunday, March 31, 2024

স্কুলের পাঠ্যক্রমে জমিজমা-সংক্রান্ত বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত করা হবে: ভূমিমন্ত্রী

 

 

গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদ অডিটরিয়ামে ভূমিসেবায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অংশীজনের সমন্বয়ে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখছেন ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ

জাতীয় পাঠ্যক্রমে জমিজমা-সংক্রান্ত বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। তিনি বলেছেন, ‘অনেকে জমিজমা-সংক্রান্ত বিষয়ে কিছুই বোঝেন না। এ জন্য ভবিষ্যতে আমরা স্কুলে পাঠ্যক্রমে জমিজমার বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তাভাবনা করছি।’ গতকাল রোববার গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদ অডিটরিয়ামে ভূমিসেবায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অংশীজনের সমন্বয়ে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় উপস্থিত নাগরিক ও অংশীজনদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন তিনি।

ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘নাগরিকেরা যেন স্কুল থেকেই ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কিছু ধারণা পেতে পারেন, সে জন্য ভূমিবিষয়ক তথ্যাদি স্কুলের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আপনারা আপনাদের ভূমিবিষয়ক যেকোনো সমস্যার কথা সরাসরি সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসারকে বলবেন।’


ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে ভূমিসেবায় দুর্নীতি প্রতিরোধ করা হবে। ভূমিসচিব মো. খলিলুর রহমান, ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুস সবুর মণ্ডল এবং ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আনিস মাহমুদ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও কালেক্টর কাজী মাহবুবুল আলমের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় অন্যদের মধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) জিয়াউদ্দীন আহমেদসহ ভূমি মন্ত্রণালয়, ভূমি সংস্কার বোর্ড, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া গোপালগঞ্জ কালেক্টরেট ও স্থানীয় জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসের আওতাভুক্ত ভূমি কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।


মন্ত্রী জানান, দেশের ৩২টি উপজেলা, সার্কেল ভূমি অফিস এবং ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সঙ্গে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া উপজেলা ভূমি অফিস এবং পাটগাতী ও কুশলী ইউনিয়ন ভূমি অফিস ভূমি মন্ত্রণালয়ের ১৮০ দিনের কর্মসূচির আওতাভুক্ত করা হয়েছে এবং এ–সংক্রান্ত জেলা পর্যায়ের প্রথম মতবিনিময় সভা গোপালগঞ্জ থেকেই শুরু হয়েছে। মন্ত্রী আশা প্রকাশ করে বলেন, ১৮০ দিনের কর্মসূচির জন্য বাছাইকৃত জাতির পিতার স্মৃতিধন্য গোপালগঞ্জের ভূমি অফিসসমূহ ভূমিসেবায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।


 

পাপের আকর্ষণ থেকে মুক্তিই প্রকৃত নাজাত

 


নাজাত মানে মুক্তি, মুক্তি পাওয়া, মুক্তি দেওয়া, মুক্ত হওয়া ও মুক্ত করা। রমজানের নাজাতের অর্থ হলো এই মাসে মানুষ পাপ–পঙ্কিলতা, গুনাহ ও আবিলতা থেকে মুক্ত হবে, জাহান্নাম থেকে মুক্ত হবে; পাপের আকর্ষণ থেকে মুক্ত হবে। গাইরুল্লাহর মহব্বত থেকে মুক্ত হবে, দুনিয়ার মহব্বত থেকে মুক্ত হবে। আল্লাহর আজাব ও গজব থেকে মুক্ত হবে, আসমানি–জমিনি ও রুহানি–জিসমানি (আত্মিক–শারীরিক) রোগ–শোক, জরা–ব্যাধি থেকে মুক্ত হবে।

নবী–রাসুলগণ মাছুম বা নিষ্পাপ হওয়ার কারণে তাঁরা শয়তানি কুমন্ত্রণা ও রিপুর তাড়না থেকে মুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া যেসব মুমিন মুসলিম শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব ধরনের পাপ থেকে মুক্ত থাকার সৌভাগ্য লাভ করেন, তাদের মাদারজাদ (আজন্ম) ওলি বলা হয়। সব মানুষের সঙ্গে শয়তান নিয়োজিত আছে, (সুরা-৫০ কফ, আয়াত: ২৭)। আর জীবনে–মরণে ও ইহকালে–পরকালে একাত্ম সঙ্গী হিসেবে নফস রয়েছে। নফস হলো ষড়্‌রিপু, তথা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য।

পবিত্র মাহে রমজানে জিন শয়তানকে বন্দী করে রাখা হয়। কিন্তু মানুষ শয়তান ও নফস শয়তান তখনো সক্রিয় থাকে। তাই মানুষ পাপাচার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারে না। পাপতাপ থেকে পরিপূর্ণভাবে মুক্তির জন্য প্রথমে ষড়্‌রিপুর তাড়না থেকে মুক্ত হয়ে নফস শয়তানকে পরাভূত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মনুষ্য শয়তানের প্রভাবমুক্ত হওয়ার জন্য অসৎসঙ্গ ত্যাগ করে সৎসঙ্গ অর্জন করতে হবে। এই দুটি সুসম্পন্ন হলেই পরিপূর্ণরূপে শয়তানের প্রভাব থেকে আত্মরক্ষা করা যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, আর সত্যবাদীগণের সঙ্গী হও।’ (সুরা-৯ তাওবাহ, আয়াত: ১১৯)।

নাফস তথা রিপুর সমন্বয়ে গঠিত মানবসত্তার তিন অবস্থা—যথা নাফসে আম্মারা, নাফসে লাউওয়ামা; নাফসে মুতমাইন্না। নাফসে আম্মারা ‘পাপাকৃষ্ট সত্তা’, যে পাপে অনুরক্ত ও পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত। (সুরা-১২ ইউসুফ, আয়াত: ৫৩)। নাফসে লাউওয়ামা ‘অনুতপ্তসত্তা’; যে শয়তানের ধোঁকায় বা রিপুর তাড়নায় অথবা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রভাবে সাময়িক পাপ করে এবং লজ্জিত, অনুতপ্ত হয়ে তওবাও করে। অর্থাৎ কখনো পাপে অনুরাগ আবার কখনো তাতে অনুতাপ হয়। (সুরা-৭৫ কিয়ামাহ, আয়াত: ২)। নাফসে মুতমাইন্না ‘প্রশান্ত আত্মা’, যার পাপের প্রতি বিরাগ এবং নেকির প্রতি অনুরাগ থাকে। (সুরা-৮৯ ফাজর, আয়াত: ২৭-৩০)।

নাফসে আম্মারা ও নাফসে লাউওয়ামাকে নাফসে মুতমাইন্নায় পরিণত করাই রমজানের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর তাকে তার অসৎ কর্ম ও সৎ কর্মের জ্ঞান দান করেছেন। সে নিশ্চিত সফল হলো, যে তার নাফসকে পবিত্র করল; আর সে ব্যর্থ হলো, যে নাফসকে কলুষিত করল।’ (সুরা-৯১ শামস, আয়াত: ৮-১০)। নাজাতের অর্থ হলো সব দোষত্রুটি থেকে নিজেকে মুক্ত করা ও পবিত্র রাখা এবং সদগুণাবলি অর্জন করে স্থায়ী মুক্তি নিশ্চিত করা। যাতে নাফসে মুতমাইন্না অবস্থা থেকে পুনরায় লাউওয়ামা বা আম্মারার দিকে ফিরে না যায়।

নাজাত বা মোহমুক্তির উপায় হলো তাওবাহ ও ইস্তিগফার করা। তওবা মানে হলো পাপ ছেড়ে পুণ্যে মনোনিবেশ করা। ইস্তিগফার হলো কৃত অপরাধের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়েÿক্ষমা প্রার্থনা করা এবং পুনরায় ওই অপরাধ বা পাপ না করার অঙ্গীকার করা ও দৃঢ়সংকল্প হওয়া।

জাগতিক সব মোহ–মায়া আকর্ষণ থেকে মুক্ত হওয়ার চমৎকার একটি মাধ্যম হলো ইতিকাফ। এতে বান্দা সবকিছু থেকে মুক্ত হয়ে একান্তভাবে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। আল্লাহ তাআলা কোরআন করিমে বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর দিকে পালিয়ে আসো।’ (সুরা-৫১ জারিয়াত, আয়াত: ৫০)। পাপ থেকে পাপের অকল্যাণ ও অমঙ্গল থেকে, পাপের ভয়ংকর ভয়াবহ মন্দ পরিণতি থেকে সর্বোপরি পাপের আকর্ষণ ও মোহ থেকে আত্মরক্ষার জন্য ও মুক্ত হওয়ার জন্যই ইতিকাফ। হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম মহিমান্বিত রজনী শবে বরাত প্রাপ্তির জন্য ইতি

কাফ। রমজানের বিশেষ সুন্নতে মুআক্কাদা কিফায়া আমল ইতিকাফ। ইতিকাফ তাকওয়ার রুদ্ধদ্বার প্রশিক্ষণ।

রোহিঙ্গা-রাখাইন সংঘাত বাঁধাতে ফের বেপরোয়া মিয়ানমারের সেনাবাহিনী

 

১৯ মার্চ বুথিডাং শহরে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের প্রতিবাদ করতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রতিটি পরিবার থেকে একজনকে সেই প্রতিবাদে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।ছবি: দ্য ইরাবতি

রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের জান্তা সরকার আবার ‘জাতিগত বিভেদের কার্ড’ খেলতে শুরু করেছে। রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের অনেকে সেই ফাঁদে পড়েছে। আরও স্পষ্ট করে বললে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা গোঁড়া, তারা জান্তার খেলায় পুতুলের মতো নাচতে শুরু করেছে।

রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে সম্পর্ক গত ছয় বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি হয়েছে। অনেকগুলো ঘটনা ও উদার কর্মকাণ্ড এই সম্পর্ক উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে।

২০১৮-১৯ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির (এএ) যুদ্ধের সময় রোহিঙ্গারা রাখাইনদের খাবার ও পরিবহন দিয়ে সমর্থন দিয়েছিল। কালাদান নদী পার হয়ে রাখাইনদের পালিয়ে যেতে রোহিঙ্গা মাঝিরা সহায়তা করেছিলেন। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে খেলার প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়েছে। এসব প্রতিযোগিতার আয়োজক রোহিঙ্গা ও রাখাইন সম্প্রদায় ও আরাকান আর্মি।

ঘূর্ণিঝড় মোচার পর রোহিঙ্গারা যে যৎসামান্য সহযোগিতা পেয়েছে, তা তারা রাখাইনদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিয়েছে। রোহিঙ্গারা সিত্তে শহরে এখন শান্তিপূর্ণভাবে চলাফেরা করতে পারে।

যা–ই হোক, এখনো অনেক মানুষ আছেন, যাঁদের মধ্যে শিক্ষার ঘাটতি আছে, যাঁরা কোনো কিছুর ভালো-মন্দ চিন্তা করতে পারেন না এবং অন্য সম্প্রদায়কে এখনো পুরোনো কুসংস্কার দিয়ে বিচার করেন।

রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে যাঁরা রাখাইন রাজ্যের বাইরে কিছুদিন ধরে বাস করছেন অথবা যাঁদের জন্ম অন্য দেশে, তাঁরা এখনো রাখাইনদের বিরুদ্ধে ঘৃণা পোষণ করে চলেছেন।

টুইটারে (এখন এক্স) একজন টুইট করেছেন এই বলে যে ‘আরাকান রোহিঙ্গাদের রাজ্য’। আরেকজন টুইট করেছেন, ‘লড়াই ছাড়া ন্যায় প্রতিষ্ঠার বিকল্প পথ নাই’। এ টুইটগুলো প্ররোচনামূলক। এই টুইটগুলো পুরোনো ধ্যানধারণার রাখাইনদের মধ্যে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকেই রাখাইনদের মধ্যে এই উদ্বেগ রয়েছে যে রোহিঙ্গারা তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র চায়।

এখন যখন রাখাইন রাজ্যে জান্তার সেনাবাহিনী ব্যাপক পরাজয়ের মুখে, তখন তারা মরিয়া হয়ে আবারও জাতি কার্ড খেলতে শুরু করেছে। কিছুদিন আগে, সিত্তে শহরের কাছে রোহিঙ্গা–অধ্যুষিত অঞ্চল অং মিনগালারে ডাকাতি ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আরাকান আর্মির ঘাড়ে দায় চাপানো হয়। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে যে এ ঘটনার পেছনে জান্তা সরকারের প্রক্সি বাহিনী আরাকান লিবারেশন আর্মি (এএলএ) দায়ী।

আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে সর্বশেষ প্রতিবাদটি হয়েছে ২৩ মার্চ সকালে সিত্তে শহরের বুমে রোহিঙ্গা বসতিতে। এবার রোহিঙ্গাদের হুমকি দেওয়া হয় যে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে না গেলে বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হবে। প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেয়, যাদের অধিকাংশ ছিল শিশু। সাদাপোশাকের পুলিশ প্রতিবাদ কর্মসূচি তদারক করে। সামরিক জান্তার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা সেটা রেকর্ড করে।

এর কয়েক দিন পর, সিত্তেতে অবস্থিত অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের (আইডিপি) শিবির থেকে ৪০০ রোহিঙ্গাকে নিয়ে আসা হয়। দেশব্যাপী সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগের যে আইন পাস করেছে জান্তা সরকার, তার অংশ হিসেবে ক্যাম্প থেকে তাঁদের নিয়ে আসা হয়। দুই সপ্তাহের সামরিক প্রশিক্ষণের পর তাঁদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়। এ কাজের পেছনে জান্তা সরকারের উদ্দেশ্য হলো, আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে এই রোহিঙ্গারা যেন নিহত হন।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক গণহত্যার পর এটা খুব করে পরিষ্কার, রোহিঙ্গারা জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে মোটেই ইচ্ছুক নন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণের ভিডিও দেখে রাখাইনদের কেউ কেউ ভাবছেন, রোহিঙ্গারা জান্তা সরকারের সেনাবাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন। অনেকে রোহিঙ্গাদের বিদ্রূপ করছেন ও হুমকি দিচ্ছেন। এর ফলে রোহিঙ্গাদের অনেকে সিত্তে শহরের বাজারে যেতে ভয় পাচ্ছেন।

১৯ মার্চ বুথিডাং শহরে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের প্রতিবাদ করতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রতিটি পরিবার থেকে একজনকে সেই প্রতিবাদে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। তাঁদের হাতে প্ল্যাকার্ড ধরিয়ে দেওয়া হয়। একই দিন মংডুর কাছাকাছি কেয়িন তান গ্রাম থেকে ৫০ জন রোহিঙ্গাকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ধরে নিয়ে যায় জান্তা সেনারা।

বেশির ভাগ রাখাইন বোকার মতো এই বিশ্বাস করতে রাজি নন যে যে সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা গণহত্যা চালিয়েছে, তাঁরা জান্তার পক্ষ হয়ে লড়াই করবেন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে রাখাইনদের কেউ কেউ সেটা বিশ্বাসও করছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে বুথিডাং শহরের ওই প্রতিবাদের পর একজন রাখাইন নারী টিকটক ভিডিওতে রোহিঙ্গাদের বিদ্রূপ করে ‘কালা’ (খুবই অসম্মানসূচক শব্দ) বলেছেন ও হুমকি দিয়েছেন। একজন বর্ণবাদী ধর্মগুরু মিথ্যা প্রচার চালিয়ে বলেছেন, ৩০০ জন মুসলমান মসজিদ থেকে ‘জিহাদ’ চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এসেছেন।

এ খবর পাওয়া গেছে যে বুথিডাং শহরে কিছু আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সদস্য রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। বিষয়টি জান্তা সরকার জানে। এই জল্পনা আছে যে জান্তা সরকার আরসাকে সহযোগিতা করছে। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে আরসা যখন প্রথম দৃশ্যপটে হাজির হয়, তখন থেকেই গুজব আছে যে আরসার সঙ্গে সেনাবাহিনীর যোগসূত্র আছে।

রোহিঙ্গাদের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে জানা যাচ্ছে, বুথিডাং শহরের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ২০ মার্চ আগুন লাগে। এতে প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা গৃহহারা হয়েছেন। গুজব ছড়িয়েছে, রোহিঙ্গা চরমপন্থীদের সঙ্গে নিয়ে আরাকান আর্মি আগুন দিয়েছে।

আগুনের উৎস সম্পর্কে এই লেখক নিশ্চিত নন। জান্তা সরকার কীভাবে গুজব ছড়াতে ও জাতিগত সংঘাত উসকাতে ব্যবহার করছে, আগুনের এই ঘটনা তার দৃষ্টান্ত।

আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে সর্বশেষ প্রতিবাদটি হয়েছে ২৩ মার্চ সকালে সিত্তে শহরের বুমে রোহিঙ্গা বসতিতে। এবার রোহিঙ্গাদের হুমকি দেওয়া হয় যে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে না গেলে বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হবে। প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেয়, যাদের অধিকাংশ ছিল শিশু। সাদাপোশাকের পুলিশ প্রতিবাদ কর্মসূচি তদারক করে। সামরিক জান্তার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা সেটা রেকর্ড করে।

রাখাইন রাজ্যে বড় বিপর্যয় দেখে জান্তা সরকার যত দ্রুত সম্ভব জাতিগত বিভক্তি তৈরি করতে চাইছে। প্রশ্ন হলো, জান্তার এই খেলায় রাখাইন ও রোহিঙ্গারা কতটা প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন। সেটা নির্ভর করবে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে রাখাইনদের মিলমিশ কতটা গভীর হয়েছে, 


৩২ বছর কারাবাসের পর মুক্ত শাহজাহান বিয়ে করে আবার মামলায়

 


গত বছর ১৮ জুন কেরাণীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান শাহজাহান ভূঁইয়া (সাদা প্যান্ট ও শার্ট পরিহিত)ছবি: আহমদুল হাসান

বঙ্গবন্ধুর খুনি ও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর করা শাহজাহান ভূঁইয়া জল্লাদ হিসেবে সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলেন। গত বছর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরও তিনি খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন। ৬৬ বছর বয়সী শাহজাহান ভূঁইয়া নতুন জীবন শুরু করেছিলেন ঢাকার কেরানীগঞ্জের গোলামবাজার এলাকায়। সেখানে একটি চায়ের দোকান দিয়ে বসেছেন। ২৩ বছর বয়সী এক তরুণীকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই সুখের সংসার বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।

গত বছরের ২১ ডিসেম্বর সাথী আক্তার নামের ওই তরুণীকে বিয়ে করেন শাহজাহান। কিন্তু ৫৩ দিনের মাথায় তাঁর ঘর ছেড়ে যান সাথী। আদালতে শাহজাহানের বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলাও দিয়েছেন। পাল্টা আজ রোববার ওই তরুণী এবং তাঁর মায়ের বিরুদ্ধে প্রতারণার একটি মামলা করেছেন শাহজাহান। মামলায় তিনি বলেছেন, ওই তরুণী ও তাঁর মা বিয়ের ফাঁদে ফেলে তাঁর (শাহজাহান) কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তরুণীর মামা।

শাহজাহান ভূঁইয়ার জন্ম নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ইছাখালী গ্রামে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। হত্যা ও অস্ত্র মামলায় তাঁর ৪২ বছরের সাজা হয়েছিল। ফাঁসি কার্যকর ও অন্যান্য কারণে তাঁর সাজার মেয়াদ কমিয়ে ৩২ বছর করা হয়। কারাগারের নথি অনুসারে, ১৯৯২ সালের ৮ নভেম্বর ডাকাতির জন্য ১২ বছর এবং ১৯৯৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর অপর একটি মামলায় ডাকাতি ও হত্যার জন্য ৩০ বছরের কারাদণ্ড হয় তাঁর।

শাহজাহানের আইনজীবী ওসমান গনি প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর স্থানীয় একজন চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে এলাকাছাড়া হন শাহজাহান। প্রায় তিন যুগ কারাভোগের পর গত বছর জুনে মুক্তি পান তিনি।

কারাগারের নথি অনুযায়ী, কারাবন্দী থাকাকালে শাহজাহান ভূঁইয়া ২৬ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ছয় খুনি, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আবদুল কাদের মোল্লা, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মীর কাসেম আলী ও জেএমবির দুই জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর করেছেন তিনি।

যেভাবে তরুণীর সঙ্গে শাহজাহানের পরিচয় ও বিয়ে

মামলার নথি ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাষ্যমতে, গত বছরের ১৮ জুন কারামুক্তির পর শাহজাহান ভূঁইয়া ঢাকার কেরানীগঞ্জের গোলামবাজারে বসবাস শুরু করেন। এরপর সেখানে একটি চায়ের দোকান দেন। একদিন সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে কেরানীগঞ্জের কদমতলী থেকে কোনাখালায় যাচ্ছিলেন। তখন গাড়ির ভেতর তিনি একটি ভ্যানিটি ব্যাগ খুঁজে পান। পরে ব্যাগের ভেতর থাকা কাগজে লেখা ছিল একটি মুঠোফোন নম্বর। সেই নম্বরে ফোন করে শাহজাহান ভ্যানিটি ব্যাগের মালিককে ব্যাগ নিয়ে যেতে বলেন। পরে ব্যাগের মালিক ২৩ বছরের এক তরুণী তাঁর বান্ধবীকে নিয়ে কেরানীগঞ্জের গোলামবাজারে হাজির হন। পরে তরুণীর মা শাহিনূর বেগমের সঙ্গে শাহজাহানের পরিচয় হয়। শাহজাহানের দাবি, মুঠোফোনে পরিচয়ের পর তরুণীর সঙ্গে তিনি বেশ কয়েকবার কথা বলেন। একপর্যায়ে তরুণী ও তাঁর মা জুরাইন থেকে কেরানীগঞ্জের গোলামবাজারে চলে আসেন। শাহজাহান ভূঁইয়ার বাসায় রান্নার কাজ নেন তিনি। পরিচয়ের দেড় মাস পর ২১ ডিসেম্বর তরুণীর সঙ্গে পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহরে শাহজাহানের বিয়ে হয়। বিয়ের দুই মাসের মাথায় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ওই তরুণী শাহজাহানের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে যৌতুক নিরোধ আইনে নালিশি মামলা করেন।


মামলায় তরুণী দাবি করেন, বিয়ের উপঢৌকন হিসেবে শাহজাহানকে এক লাখ টাকার মালামাল দেয় তাঁর পরিবার। পাশাপাশি নগদ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বিয়ের কয়েক দিন পর তাঁদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ শুরু হয়। তাঁকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতে থাকেন শাহজাহান ভূঁইয়া। একই সঙ্গে শাহজাহান তিন লাখ টাকা যৌতুক দাবি করেছেন বলে মামলায় অভিযোগ করেন তরুণী।

ঢাকার সিজেএম আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবীর জানান, শাহজাহানের বিরুদ্ধে করা মামলাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) আদালত।

তবে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ মামুন অর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, শাহজাহান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে তরুণীর দায়ের করা কোনো মামলার কাগজপত্র কিংবা আদালতের কোনো আদেশ হওয়ার তথ্য তাঁর জানা নেই।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহজাহান ভূঁইয়া প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তরুণীকে শারীরিক কিংবা মানসিক কোনো প্রকারের নির্যাতন তিনি করেননি। যৌতুক চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। বরং ওই তরুণী প্রতারণা করে তাঁর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

শাহাজাহন ভূঁইয়া আজ ওই তরুণী ও তাঁর মাসহ ছয়জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেছেন। মামলায় তিনি অভিযোগ করেছেন, তরুণী ও তাঁর মা বিয়ের আগে নানা কৌশলে তাঁর কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা নেন। বিয়ের দিন একটি অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করে তরুণী তাঁর কাছ থেকে আরও ১০ লাখ টাকা নেন। শাহজাহান বলেন, কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে তাঁকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয়। আর কারাগারে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। তাঁদের কাছ থেকে আশীর্বাদ হিসেবে পাওয়া টাকাসহ মোট ১৮ লাখ টাকা তিনি সাহায্য হিসেবে পান। সেই টাকা দিয়েই তিনি এই বিয়ে করেছেন।

তরুণীর সঙ্গে শাহজাহানের করা অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ রয়েছে, তরুণী ১০ লাখ টাকা শাহজাহানের কাছ থেকে বুঝে নিয়েছেন। বিয়ে বলবৎ রাখতে অপারগ হলে তিনি ১০ লাখ টাকা শাহজাহানকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হবেন। অঙ্গীকারনামায় আরও উল্লেখ রয়েছে, বিয়ের চার মাসের মাথায় শাহজাহান তরুণীর নামে ২ শতাংশ জমি হেবা (দান) করবেন। স্ত্রী হিসেবে স্বামী শাহজাহানের আদেশ তরুণী মেনে চলবেন। স্বামী–স্ত্রী হিসেবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সম্পর্ক উন্নয়নসহ সব ধরনের কাজ করতে বাধ্য থাকবেন। অঙ্গীকারনামায় তরুণী ও শাহজাহানের স্বাক্ষর রয়েছে।  

মামলায় শাহজাহান দাবি করেন, বিয়ের কিছুদিন পর স্ত্রী ও শাশুড়ি তাঁর সঙ্গে খারাপ আচরণ করা শুরু করেন। বিয়ের ৫৩ দিনের মাথায় স্ত্রী তাঁর বাসা থেকে বেরিয়ে যান। শাহজাহানের সঙ্গে সংসার করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। পরে শাহজাহান অঙ্গীকারনামার শর্ত অনুযায়ী স্ত্রীকে দেওয়া ১০ লাখ টাকা ফেরত চান। তখন তাঁরা সেই টাকা দিতে অস্বীকার করেন। স্ত্রী, শাশুড়িসহ অন্যদের বিরুদ্ধে করা প্রতারণার মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে সাথী আক্তারের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে তাঁর মামা দীন ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মুঠোফোনে শাহজাহানের সঙ্গে তাঁর ভাগনি সাথী আক্তারের পরিচয় হয়। এরপর নানা প্রলোভন দেখিয়ে তিনি সাথীকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তাঁর আচরণ ভালো ছিল না। ভয়ভীতি ও মারধরের কারণে সাথী শাহজাহানের বাসা থেকে চলে আসে।

দীন ইসলাম বলেন, ১০ লাখ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও কোনো টাকা দেননি শাহজাহান ভূঁইয়া। কিন্তু অঙ্গীকারনামায় সাথীর স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছিল।