Tuesday, July 9, 2024

২১ বছরে ২০ পুলিশ হত্যা, রায় মাত্র তিনটির

 

২০১০ সালের ১৯ এপ্রিল মাঝরাত! কর্মস্থল রাজধানীর বংশাল থানা থেকে পুরান ঢাকার ওয়ারীর বাসায় ফিরছিলেন পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) গৌতম রায়। পথে ধোলাইখালে সন্দেহজনক গতিবিধি দেখে তিনজনকে তিনি তল্লাশি করতে যান। তাঁদের একজন গৌতমের বুকের বাঁ পাশে ও কোমরের পেছনে গুলি করেন। ঘটনাস্থলেই মারা যান গৌতম। পরিবারের দাবি, এটি ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

এই খুনের পর ১৪ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো শেষ হয়নি মামলার বিচার। অভিযোগ গঠনের পর ৪৭ সাক্ষীর মাত্র ১৬ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। শুধু গৌতম রায়ই নন, গত ২১ বছরে রাজধানীতে অন্তত ২০ পুলিশ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে মোট ১৮টি। এর মধ্যে মাত্র ৩টি মামলার রায় হয়েছে। তদন্তাধীন আছে দুটি। তিনটি মামলার কার্যক্রম উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। বাকিগুলো বিচারাধীন। তদন্তে ধীরগতির সুযোগ নিয়ে এসব মামলার বেশির ভাগ আসামি জামিনে। কেউ কেউ আবার পালিয়েছেন বিদেশে।

নিহত গৌতমের ভাই তিলক রায় সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ সদস্য হত্যার বিচারও যদি না হয়, এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে? যিনি অসংখ্য মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন, তাঁর হত্যার রহস্যই উদ্ঘাটিত হলো না। হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রটিও এত বছরেও উদ্ধার হয়নি। এ অবস্থাতেই পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়েছে।’ তিলক রায়ের অভিযোগ, নিখুঁত নিশানায় গুলি করে খুন করা একটি ঘটনাকে পুলিশ খুব সাধারণভাবে উপস্থাপন করেছে। তাঁদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও মামলাটিতে পুলিশ বাদী হয়। এ জন্য তাঁরাও বিচারে গতি ফেরাতে তেমন কিছু করতে পারছেন না।

দেশে হত্যা মামলার তদন্ত ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ পুরোনো। বিচারে ‘কচ্ছপগতি’র জন্য পুলিশের ভূমিকা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। তবে নিজেদের সদস্য হত্যার বিচারেও ধীরগতি নিয়ে বাহিনীর ভেতরে ও বাইরে নানা সমালোচনা রয়েছে। পুলিশের বর্তমান ও সাবেক ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত তদন্তে দুর্বলতা ও গাফিলতি এবং সাক্ষী ঠিকঠাক হাজির করতে না পারায় পুলিশ হত্যার মতো স্পর্শকাতর মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে না।

বিচারে দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও সাবেক সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘসূত্রতার অনেকগুলো কারণ আছে। যে সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করা প্রয়োজন, পুলিশ সেটি করে না বা করতে পারে না। সাক্ষী হাজির করার দায়িত্বও পুলিশের। এই কাজটি সঠিকভাবে হচ্ছে না। তারা যদি কঠোর হয়, তাহলে সাক্ষী ঠিকমতোই হাজির হবে। তা ছাড়া ভালো তদন্তকারী কর্মকর্তা তৈরি না হওয়াও বিচারে দীর্ঘসূত্রতার অন্যতম কারণ। বিশেষ মামলাগুলো দায়িত্ব নিয়ে শেষ করা প্রয়োজন।

—মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়ার অন্যতম কারণ তদন্তে দুর্বলতা ও গাফিলতি এবং সাক্ষী ঠিকঠাক হাজির করতে না পারা।
—নিজেদের সদস্য হত্যার বিচারেও ধীরগতি নিয়ে পুলিশ বাহিনীর ভেতরে ও বাইরে নানা সমালোচনা রয়েছে।

তদন্তে দুর্বলতা

তদন্তে দুর্বলতা ও ধীরগতির কারণে পুলিশ সদস্য হত্যার অনেক মামলার বিচারে দীর্ঘসূত্রতা বাড়ে। ২০১৩ সালের ২৯ আগস্ট রাজধানীর পশ্চিম রামপুরার বাড়িতে গুলি করে খুন করা হয় পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. ফজলুল করিম খানকে। কয়েকটি আলোচিত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ফজলুল। চার বছর তদন্ত শেষে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ ২৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয়। ২০১৭ সালে দেওয়া ওই অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি দেওয়া হয়।

নারাজির পর মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠান আদালত। এরপর ২০১৮ সালের ২০ মে ২৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। মৃত্যুর প্রায় ১১ বছর পর চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি আসামিদের বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। এই মামলায় ৩৭ জনের সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া গত বছর কনস্টেবল মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার হত্যা ও কনস্টেবল মো. আমিরুল হক হত্যা মামলার তদন্তই এখন পর্যন্ত শেষ করতে পারেনি পুলিশ।

হাজির হয় না সাক্ষী

পুলিশ হত্যার মামলাগুলোর নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অধিকাংশ মামলায় ঠিকঠাক সাক্ষী হাজির করা হয়নি। বেশির ভাগ মামলায় পেশাগত বাধ্যবাধকতার কারণে কেবল পুলিশ সদস্যরাই সাক্ষ্য দিয়েছেন। এর বাইরে সাধারণ সাক্ষীর সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায়।

২০১৮ সালের ২০ মার্চ ঢাকার পীরেরবাগ এলাকায় অভিযান চালাচ্ছিলেন ডিবি পরিদর্শক মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন। হারানো পিস্তলের খোঁজে অভিযান চলাকালে অপরাধীদের গুলিতে মারা যান তিনি। এ ঘটনায় মিরপুর থানার বিচারাধীন মামলায় ৩৫ সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত ২০ জনের সাক্ষ্যই গ্রহণ করা হয়নি।

সাক্ষী হাজিরের দায়িত্ব পুলিশের, কাজটি সঠিকভাবে হচ্ছে না। তারা যদি কঠোর হয় তাহলে সাক্ষী ঠিকমতোই হাজির হবে।
নূর মোহাম্মদ, সাবেক আইজিপি

হরতাল-অবরোধের মধ্যে রাজধানীর মৎস্য ভবনের সামনে পুলিশ ভ্যানে পেট্রলবোমা ছুড়লে মারা যান পুলিশ সদস্য শামীম মিয়া। ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারির এ ঘটনার তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ১৪ জুলাই আটজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। মামলার ৫৯ সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত একজনও আদালতে সাক্ষ্য দেননি।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ সাক্ষী হলে সাক্ষ্য গ্রহণ সহজ হয়। অন্য সাক্ষীরা অনেক সময় আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে চান না। এটিই মূল সমস্যা। তা ছাড়া এই মামলাগুলো যতখানি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত, সেভাবে হয়তো দেখা হয়নি। আমরা সমস্যাগুলো নিরসনে কাজ করব।’

কেউ জামিনে, কেউ বিদেশে

বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ায় চাঞ্চল্যকর অনেক মামলার আসামিরা জামিনে রয়েছেন। দেশের বাইরে পালিয়েছেন শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ অনেকে। পলাতক আসামিদের ফেরাতে পুলিশের উদ্যোগও নামমাত্র।

প্রায় ২১ বছর আগে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে খুন হন পুলিশের পরিদর্শক নূরুল আলম শিকদার এবং উপপরিদর্শক আলমগীর হোসেন। ২০০৩ সালের ১৫ মে রাতে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ ওরফে মন্টি ও তাঁর সহযোগীরা এই দুই পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০০৭ সালে ৭ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। চার্জ গঠনের পর এখন পর্যন্ত ৭৫ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫৭ জনেরই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়নি। বর্তমানে জিসান দুবাইয়ে পলাতক বলে জানিয়েছে পুলিশ।

পুলিশ সদস্য হত্যার বিচারও যদি না হয়, এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে? যিনি অসংখ্য মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন, তাঁর হত্যার রহস্যই উদ্ঘাটিত হলো না।
তিলক রায়, এসআই গৌতমের ভাই

গাজীপুরের একটি জঙ্গল থেকে পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খানের লাশ উদ্ধার করা হয় ২০১৮ সালের ৯ জুলাই। তার আগের দিন বন্ধু রহমত উল্লাহর সঙ্গে বনানীর একটি বাসায় গিয়ে খুন হন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এ কর্মকর্তা। হত্যার পর মামুনের লাশটি বস্তায় ভরে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে। ২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল ডিবি পুলিশ এ ঘটনায় অভিযোগপত্র দেয়। এই মামলার ৩৮ সাক্ষীর মধ্যে ২৪ জন এখন পর্যন্ত আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। ইমরান খুনের আলোচিত আসামি আরাভ খান ঘটনার পর ভারতে পালিয়ে যান। বর্তমানে তিনি দুবাইয়ে আছেন।

২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে নিহত হন এসআই শাহজাহান। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মাত্র একজন আসামি কারাগারে আছেন। বাকি ২৪ জনই এখন জামিনে। এই মামলার কার্যক্রম উচ্চ আদালতের নির্দেশে এখন স্থগিত আছে।
গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এতে নিহত হন পুলিশ সদস্য মো. আমিরুল ইসলাম। এ ঘটনায় পল্টন থানার মামলায় সাত আসামিই এখন জামিনে আছেন।

জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন জমায় বিলম্ব পুরো বিচারে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করে। চার-পাঁচ বছর পর যদি একটি হত্যা মামলার প্রতিবেদন দেওয়া হয়, তত দিনে অনেক সাক্ষীর ঠিকানা পরিবর্তন হয়ে যায়। তখন তো অনেক দূর থেকে তারা সাক্ষী দিতে আসতে চাইবে না। অপরদিকে পুলিশ সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে বেশি ব্যবহৃত হয়। অথচ অপরাধের তদন্ত ও অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা তাদের মুখ্য কাজ। তারা এই কাজ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।


নিয়মিত অর্থ সঞ্চয় করলে ঘুম ভালো হয়, বলছে গবেষণা

 

প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সঞ্চয়ের অভ্যাস মানুষের মনে অনেকটাই প্রশান্তি এনে দিতে পারে। মানুষ তখন ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক বেশি আশাবাদী হয়ে উঠতে পারে। তাই অল্প পরিমাণে হলেও সবারই নিয়মিত অর্থ সঞ্চয় করা উচিত। যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির নতুন এক গবেষণায় এমনটাই দেখা গেছে।

গবেষকেরা বলছেন, নিম্ন আয়ের মানুষদের মধ্যে যাঁরা নিয়মিত সঞ্চয় করেন, তাঁদের জীবনে সন্তুষ্টির মাত্রা সঞ্চয় না করা ধনী মানুষদের মতোই।

খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থ সঞ্চয়ের কাজটি কঠিন হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের এক–চতুর্থাংশেরই ১০০ পাউন্ডের কম সঞ্চয় আছে।

প্রতি ১০ জনে ৬ জন মানুষের সঞ্চয়ের অভ্যাস আছে। দাতব্য সংস্থাগুলোর দাবি, আয় কম হলেও নিয়মিত সঞ্চয় করা হলে তা আর্থিক স্থিতি আনে।

ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির পারসোনাল ফিন্যান্স রিসার্চ সেন্টার প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কম করে হলেও নিয়মিত সঞ্চয়ের অভ্যাস জীবন নিয়ে মানুষের সন্তুষ্টি বাড়ায়।

এর কারণও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, সঞ্চয় করলে মানুষের অর্থসংক্রান্ত দুশ্চিন্তা কমে। তাঁদের দেনাসংক্রান্ত সমস্যায় পড়তে হয় না। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিগুলোকে তাঁরা তখন অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে সামাল দিতে পারেন।

তবে যাঁরা ইতিমধ্যে সঞ্চয় করে ফেলেছেন এবং বিভিন্ন বয়সের পরিবর্তিত পরিস্থিতিসহ অন্য বিষয়গুলো বিবেচনা করতে গেলে এ চিত্র তুলনামূলক জটিল হয়ে পড়ে।

নতুন গবেষণাটি করতে গিয়ে ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা পুরোনো কিছু গবেষণার তথ্যকেও বিবেচনায় নিয়েছেন। এর মধ্যে কয়েক হাজার মানুষের ১০ বছরের সঞ্চয়ের তথ্যও আছে।

গবেষকেরা বলছেন, সঞ্চয় করলে যেমন জীবনের সন্তুষ্টি আসে, তেমনি না করলে মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে।

গবেষকেরা বলেছেন, সঞ্চয় ছাড়াও জীবনঘনিষ্ঠ আরও কিছু বিষয় মানুষের মনের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন ঘরবাড়ি বদল কিংবা বিয়ে করার মতো বিষয়গুলো মানসিক অবস্থার বড় ধরনের উন্নতি ঘটাতে পারে। চাকরি হারানোর মতো ঘটনা মানুষের মনের ওপর বড় ধরনের বাজে প্রভাব ফেলতে পারে।

চাকরির প্রশ্নপত্র ফাঁসে তাঁরা জড়িত, জানত পিএসসি

 

রেলওয়ের একটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গত সোমবার গ্রেপ্তার হওয়া ১৭ জনের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) কর্মকর্তা-কর্মচারী ছয়জন। এর মধ্যে পাঁচজন এখনো কর্মরত। আরেকজনকে ১০ বছর আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল।

যে পাঁচজন এখন কর্মরত রয়েছেন, তাঁদের সবার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। এর মধ্যে তিনজনের ক্ষেত্রে অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছিল পিএসসি। যে কারণে একজনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। একজনকে ঢাকার প্রধান কার্যালয় থেকে সিলেটে বদলি করা হয়। আরেকজনকে বরখাস্ত করা হলেও আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি দায়িত্ব ফিরে পান।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া সাংবিধানিক সংস্থা পিএসসির বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছেন উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম। আরও আছেন সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, কর্মচারী (ডেসপাচ রাইডার) মো. খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম। এ ছাড়া রয়েছেন পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী।

আরও পড়ুন
প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িতদের মধ্যে পিএসসির বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারী ছয়জন।

এই ছয়জনের মধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার বিষয়টি পিএসসির নিজস্ব তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালে চাকরিচ্যুত হন সৈয়দ আবেদ আলী। বরখাস্ত হয়েছিলেন খলিলুর রহমান। বদলি করা হয়েছিল জাহাঙ্গীর আলমকে। আর পদোন্নতির জন্য বিবেচনা করা হয়নি আবু জাফরকে।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় পিএসসির যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম এসেছে, দেখা যাচ্ছে তাঁরা আগেও এ ধরনের গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন সময় পিএসসির নিজস্ব অনুসন্ধান ও তদন্তেই তা বেরিয়ে এসেছে। পিএসসির ভেতরেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের একটি চক্র কাজ করছে। এর মধ্যে কেউ ধরা পড়েছেন, কেউ এখনো আড়ালে রয়ে গেছেন। বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক সংস্থা পিএসসি কেন ফৌজদারি মামলা করেনি, সেই প্রশ্নও তুলেছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় অপরাধ স্বীকার করে গতকাল মঙ্গলবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন ছয়জন। এর মধ্যে পিএসসির সাবেক ও বর্তমান কর্মচারীই তিনজন। তাঁরা হলেন সৈয়দ আবেদ আলী, খলিলুর রহমান ও সাজেদুল ইসলাম।

আরও পড়ুন

গ্রেপ্তার হওয়া ১৭ জনের বিষয়ে আদালতে জমা দেওয়া সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামিরা ৫ জুলাই পিএসসির অধীনে নেওয়া বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী (নন–ক্যাডার) পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। নিয়োগ প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করেছেন তাঁরা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা স্বীকার করেছেন, বিগত বছরগুলোতেও বিভিন্ন সময়ে বিসিএসসহ পিএসসির বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে তাঁরা জড়িত ছিলেন।

সিআইডি বলছে, ৫ জুলাইয়ের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় অন্তত ৫০ জন জড়িত। এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া ১৭ জনকে গতকাল কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

আরও পড়ুন

পিএসসির ভেতরে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্র

পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফর এর আগেও বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে সাংবিধানিক এই সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, একটি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পিএসসির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তাঁর অপরাধে জড়িত থাকার বিষয়টি বেশ কয়েক বছর আগেই জানানো হয়েছিল। এ কারণে তাঁকে কয়েকবার পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।

জাফর ঢাকার মালিবাগে একটি কোচিং সেন্টার চালান। এর নাম জ্যোতি কোচিং সেন্টার। এই কোচিং সেন্টারের আড়ালে প্রশ্নপত্র কেনাবেচার কাজ চলে বলে পিএসসির একাধিক সূত্র বলছে।

আরেক উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলমও প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত, এটি পিএসসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবগত বলে জানা গেছে। যে কারণে গত ২ জানুয়ারি তাঁকে পিএসসি সচিবালয়ের (ঢাকার আগারগাঁওয়ে) প্রশাসন শাখা থেকে বদলি করে সিলেট আঞ্চলিক কার্যালয়ে পাঠানো হয়।

পিএসসির সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবিরের বিরুদ্ধেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে। মিরপুরে তাঁর একটি কোচিং সেন্টার রয়েছে।

আরও পড়ুন

পিএসসির ডেসপাচ (চিঠিপত্র আদান-প্রদান) শাখার কর্মচারী খলিলুর রহমান ৩৩তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ভুয়া প্রশ্নপত্র বিক্রি করেন। প্রশ্নপত্র বিক্রির সময় ২০১২ সালে হাতেনাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে তখন শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছিল। ২০১২ সালের ৭ অক্টোবর তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার তদন্ত করেন পিএসসির উপপরিচালক এস এম গিয়াস উদ্দীন। তদন্ত শেষে তিনি যে প্রতিবেদন জমা দেন, তাতে বলা হয় খলিলের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। পরে তাঁকে বিভাগীয় মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তখন তাঁর বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে নেয় পিএসসি।

পিএসসির একজন কর্মকর্তা বলেন, খলিলুর রহমান চাকরিতে ফিরে এলেও তাঁকে ভালো কোনো পদে দেওয়া হয়নি।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর বিরুদ্ধে প্রথমে মামলা হয়েছিল ২০১৪ সালে। ওই বছরের ২২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ‘সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার’ পদে নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় এক পরীক্ষার্থীকে বাইরে থেকে চারটি লিখিত উত্তরপত্র সরবরাহ করার অভিযোগ উঠেছিল। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পায় পিএসসি। একই বছর তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। পরে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

পিএসসির তদন্তে উঠে এসেছে, সৈয়দ আবেদ আলী ভুয়া স্থায়ী ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্ট এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সও নিয়েছেন। তদন্ত চলাকালে তিনি মাহতাব উদ্দিন নামের এক ব্যক্তিকে নিজের পিতা হিসেবে উল্লেখ করেন। যদিও তাঁর পিতার নাম আবদুর রহমান।

আরও পড়ুন

উপপরিচালককে দিয়েছিলেন ২ কোটি টাকা

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম জিজ্ঞাসাবাদে সিআইডির কর্মকর্তাদের বলেছেন, রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তিনি সংগ্রহ করেছেন উপপরিচালক মো. আবু জাফরের কাছ থেকে। এ জন্য আবু জাফরকে তিনি ২ কোটি টাকা দেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আরও বলেছেন, পিএসসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কক্ষের ট্রাংক খুলে তিনি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে সেগুলো টাকার বিনিময়ে ফাঁস করতেন। এর মধ্যে বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার (কোন বিসিএসের, সেটি জানা যায়নি) প্রশ্নপত্রও রয়েছে। এ কাজে পিএসসির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী বিভিন্ন সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন বলে জানান সাজেদুল।

এদিকে রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন গতকাল নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তদন্তে পিএসসির একজন যুগ্ম সচিবকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পিএসসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে থাকে, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এমনকি আমারও যদি কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকে, তাহলে আমিও শাস্তির বাইরে যাব না।’

আরও পড়ুন

জাহাঙ্গীরের আছে ফ্ল্যাট ও গাড়ি

প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত পিএসসির উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম পরিবার নিয়ে থাকতেন ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ডি ব্লকের ১ নম্বর সড়কের ৮/ও নম্বর ভবনের তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে। গতকাল বিকেলে ওই বাড়িতে গিয়ে কথা হয় নিরাপত্তাকর্মী বাহারুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, গত শুক্রবার পুলিশ বাসায় এসে জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়ে যায়। পরদিন জাহাঙ্গীর স্ত্রী ও দুই সন্তান বাসা থেকে বের হয়ে যান। ওই ফ্ল্যাট এখন তালাবদ্ধ।

ভবনের তত্ত্বাবধায়ক জিয়াউল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, জাহাঙ্গীর আলম যে ফ্ল্যাটে থাকতেন, সেটি তিনি কিনেছেন। ২০১৯ সালের দিকে তিনি ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন। তাঁর একটি গাড়ি রয়েছে।

জাহাঙ্গীরসহ প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া পিএসসির পাঁচজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বিষয়টি গতকাল এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানিয়েছে পিএসসসি।

আরও পড়ুন

সরকারি চাকরির বিধিবিধান বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ আসার পর পিএসসি নিজে মামলা করতে পারত, বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) পাঠাতে পারত; কিন্তু পিএসসসি সেটি করেনি।

ফিরোজ মিয়া মনে করেন, পিএসসির ভেতর থেকে কারও সহযোগিতা ছাড়া ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করতে পারার কথা নয়। হয়তো ওপরের কারও সরলতা বা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাঁরা এ অপরাধ করেছেন। এখন পিএসসির উচিত হবে নিজেদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা। এ জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা যেতে পারে। একই সঙ্গে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেও