দেশে হত্যা মামলার তদন্ত ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ পুরোনো। বিচারে ‘কচ্ছপগতি’র জন্য পুলিশের ভূমিকা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। তবে নিজেদের সদস্য হত্যার বিচারেও ধীরগতি নিয়ে বাহিনীর ভেতরে ও বাইরে নানা সমালোচনা রয়েছে। পুলিশের বর্তমান ও সাবেক ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত তদন্তে দুর্বলতা ও গাফিলতি এবং সাক্ষী ঠিকঠাক হাজির করতে না পারায় পুলিশ হত্যার মতো স্পর্শকাতর মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে না।
বিচারে দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও সাবেক সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘসূত্রতার অনেকগুলো কারণ আছে। যে সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করা প্রয়োজন, পুলিশ সেটি করে না বা করতে পারে না। সাক্ষী হাজির করার দায়িত্বও পুলিশের। এই কাজটি সঠিকভাবে হচ্ছে না। তারা যদি কঠোর হয়, তাহলে সাক্ষী ঠিকমতোই হাজির হবে। তা ছাড়া ভালো তদন্তকারী কর্মকর্তা তৈরি না হওয়াও বিচারে দীর্ঘসূত্রতার অন্যতম কারণ। বিশেষ মামলাগুলো দায়িত্ব নিয়ে শেষ করা প্রয়োজন।
—মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়ার অন্যতম কারণ তদন্তে দুর্বলতা ও গাফিলতি এবং সাক্ষী ঠিকঠাক হাজির করতে না পারা।
—নিজেদের সদস্য হত্যার বিচারেও ধীরগতি নিয়ে পুলিশ বাহিনীর ভেতরে ও বাইরে নানা সমালোচনা রয়েছে।
তদন্তে দুর্বলতা
তদন্তে দুর্বলতা ও ধীরগতির কারণে পুলিশ সদস্য হত্যার অনেক মামলার বিচারে দীর্ঘসূত্রতা বাড়ে। ২০১৩ সালের ২৯ আগস্ট রাজধানীর পশ্চিম রামপুরার বাড়িতে গুলি করে খুন করা হয় পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. ফজলুল করিম খানকে। কয়েকটি আলোচিত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ফজলুল। চার বছর তদন্ত শেষে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ ২৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয়। ২০১৭ সালে দেওয়া ওই অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি দেওয়া হয়।
নারাজির পর মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠান আদালত। এরপর ২০১৮ সালের ২০ মে ২৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। মৃত্যুর প্রায় ১১ বছর পর চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি আসামিদের বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। এই মামলায় ৩৭ জনের সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া গত বছর কনস্টেবল মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার হত্যা ও কনস্টেবল মো. আমিরুল হক হত্যা মামলার তদন্তই এখন পর্যন্ত শেষ করতে পারেনি পুলিশ।
হাজির হয় না সাক্ষী
পুলিশ হত্যার মামলাগুলোর নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অধিকাংশ মামলায় ঠিকঠাক সাক্ষী হাজির করা হয়নি। বেশির ভাগ মামলায় পেশাগত বাধ্যবাধকতার কারণে কেবল পুলিশ সদস্যরাই সাক্ষ্য দিয়েছেন। এর বাইরে সাধারণ সাক্ষীর সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায়।
২০১৮ সালের ২০ মার্চ ঢাকার পীরেরবাগ এলাকায় অভিযান চালাচ্ছিলেন ডিবি পরিদর্শক মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন। হারানো পিস্তলের খোঁজে অভিযান চলাকালে অপরাধীদের গুলিতে মারা যান তিনি। এ ঘটনায় মিরপুর থানার বিচারাধীন মামলায় ৩৫ সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত ২০ জনের সাক্ষ্যই গ্রহণ করা হয়নি।
সাক্ষী হাজিরের দায়িত্ব পুলিশের, কাজটি সঠিকভাবে হচ্ছে না। তারা যদি কঠোর হয় তাহলে সাক্ষী ঠিকমতোই হাজির হবে।
হরতাল-অবরোধের মধ্যে রাজধানীর মৎস্য ভবনের সামনে পুলিশ ভ্যানে পেট্রলবোমা ছুড়লে মারা যান পুলিশ সদস্য শামীম মিয়া। ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারির এ ঘটনার তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ১৪ জুলাই আটজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। মামলার ৫৯ সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত একজনও আদালতে সাক্ষ্য দেননি।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ সাক্ষী হলে সাক্ষ্য গ্রহণ সহজ হয়। অন্য সাক্ষীরা অনেক সময় আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে চান না। এটিই মূল সমস্যা। তা ছাড়া এই মামলাগুলো যতখানি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত, সেভাবে হয়তো দেখা হয়নি। আমরা সমস্যাগুলো নিরসনে কাজ করব।’
কেউ জামিনে, কেউ বিদেশে
বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ায় চাঞ্চল্যকর অনেক মামলার আসামিরা জামিনে রয়েছেন। দেশের বাইরে পালিয়েছেন শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ অনেকে। পলাতক আসামিদের ফেরাতে পুলিশের উদ্যোগও নামমাত্র।
প্রায় ২১ বছর আগে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে খুন হন পুলিশের পরিদর্শক নূরুল আলম শিকদার এবং উপপরিদর্শক আলমগীর হোসেন। ২০০৩ সালের ১৫ মে রাতে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ ওরফে মন্টি ও তাঁর সহযোগীরা এই দুই পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০০৭ সালে ৭ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। চার্জ গঠনের পর এখন পর্যন্ত ৭৫ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫৭ জনেরই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়নি। বর্তমানে জিসান দুবাইয়ে পলাতক বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ সদস্য হত্যার বিচারও যদি না হয়, এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে? যিনি অসংখ্য মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন, তাঁর হত্যার রহস্যই উদ্ঘাটিত হলো না।
গাজীপুরের একটি জঙ্গল থেকে পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খানের লাশ উদ্ধার করা হয় ২০১৮ সালের ৯ জুলাই। তার আগের দিন বন্ধু রহমত উল্লাহর সঙ্গে বনানীর একটি বাসায় গিয়ে খুন হন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এ কর্মকর্তা। হত্যার পর মামুনের লাশটি বস্তায় ভরে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে। ২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল ডিবি পুলিশ এ ঘটনায় অভিযোগপত্র দেয়। এই মামলার ৩৮ সাক্ষীর মধ্যে ২৪ জন এখন পর্যন্ত আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। ইমরান খুনের আলোচিত আসামি আরাভ খান ঘটনার পর ভারতে পালিয়ে যান। বর্তমানে তিনি দুবাইয়ে আছেন।
২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে নিহত হন এসআই শাহজাহান। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মাত্র একজন আসামি কারাগারে আছেন। বাকি ২৪ জনই এখন জামিনে। এই মামলার কার্যক্রম উচ্চ আদালতের নির্দেশে এখন স্থগিত আছে।
গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এতে নিহত হন পুলিশ সদস্য মো. আমিরুল ইসলাম। এ ঘটনায় পল্টন থানার মামলায় সাত আসামিই এখন জামিনে আছেন।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন জমায় বিলম্ব পুরো বিচারে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করে। চার-পাঁচ বছর পর যদি একটি হত্যা মামলার প্রতিবেদন দেওয়া হয়, তত দিনে অনেক সাক্ষীর ঠিকানা পরিবর্তন হয়ে যায়। তখন তো অনেক দূর থেকে তারা সাক্ষী দিতে আসতে চাইবে না। অপরদিকে পুলিশ সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে বেশি ব্যবহৃত হয়। অথচ অপরাধের তদন্ত ও অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা তাদের মুখ্য কাজ। তারা এই কাজ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।
0 Comments