বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন, নতুন সরকারের সামনে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং দেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া ও রাফসান গালিব।
মুনীরুজ্জামান: আমরা কার্যত একদলীয় একটি শাসনব্যবস্থার ভেতরে ঢুকে গেলাম। বহুদলীয় গণতন্ত্রের বিশ্বাসের ওপর বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে। এখন দেশের আপামর জনগণ বিশ্বাস করে যে সেখান থেকে আমরা অনেক সরে এসেছি। এই একদলীয় শাসনব্যবস্থা আদর্শগত দিক থেকে মানুষের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে, সে ব্যাপারে আমার গভীর প্রশ্ন আছে। তবে একদলীয় শাসনব্যবস্থার বড় বিপদ হচ্ছে, এখানে কোনো চেক অ্যান্ড ব্যালান্স কাজ করে না।
এর ফলে জনগণের প্রতি সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় বড় ভুল হওয়ার ঝুঁকি সরকারের জন্য সব সময় একটি হুমকি থেকে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক বিপর্যয়ের কারণে এখন অনেক প্রতিষ্ঠান খুবই দুর্বল ও ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। এটি ক্ষমতাসীনদের জন্য সুখকর হবে আমি মনে করি না।
সরকারের জন্য অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে বড়। সেটি সরকার কীভাবে সামাল দেবে?
মুনীরুজ্জামান: অর্থনৈতিক যে চ্যালেঞ্জ সামনে আসছে তা সামাল দেওয়ার সক্ষমতা সরকারের আছে, তা দেখা যাচ্ছে না। আমাদের প্রধান দুই আয়ের উৎস দুর্বল জায়গায় চলে গেছে—রেমিট্যান্স এবং তৈরি পোশাক রপ্তানি। তৈরি পোশাক খাতের বাজারে পশ্চিমা শক্তি যদি হালকাভাবেও কোনো পরিবর্তন আনে, তার বড় প্রভাব পড়বে। এ ছাড়া বাজারের সঙ্গে ডলারের মূল্যমানের যে তারতম্য হয়েছে, এটির কারণে রেমিট্যান্স বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আবার ডলারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে এর দাম এমন জায়গায় পৌঁছাবে, বাজার সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
নিত্যপণ্য আরও বেশি মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। আবার এখন যেভাবে ডলারের মূল্য কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে, সে কারণে রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে আসবে না। ফলে অর্থনৈতিক সমস্যা আরও বাড়তে থাকবে। তখন বাইরের কাছে হাত পাততে হবে—হয় সেটি পশ্চিমাদের কাছে, নয় তো চীনাদের কাছে। সরকারের প্রধান সমর্থক ভারতের সেই অর্থনৈতিক সক্ষমতা নেই যে আমাদের সরকারকে সহায়তা করবে। যে পথই ধরুক এর জন্য সরকারকে ছাড় দিতে হবে। সেটি করা সরকারের জন্য কঠিন হবে।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেখা গেল ভারত, চীন ও রাশিয়া প্রকাশ্যে সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছে। এক বছর ধরে বিবৃতি ও বক্তব্যের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও বেশ জোরালো ছিল। কিন্তু এক–দেড় মাস ধরে সেটি তেমন ছিল না। বিষয়গুলো কীভাবে দেখেন?
তৌহিদ হোসেন: আমাদের নির্বাচন নিয়ে বিশ্বের শক্তিধরেরা দুই ভাগ হয়ে গেছে। সাধারণত যেটি দেখার কথা না, তা হলো, ভারত আর চীন এখানে একই অবস্থান নিয়েছে। মূলত বাংলাদেশে গণতন্ত্র থাকল কি থাকল না, তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। নিজ নিজ রাষ্ট্রীয় স্বার্থে আসলে তাদের এই অবস্থান। এখন যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়টি হচ্ছে, তারা ভিয়েতনাম, আফগানিস্তানসহ বহির্বিশ্বে অনেক পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে। কথা হচ্ছে, পরাজয় তারা স্বীকার করতে রাজি কি না।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এক–দেড় বছর ধরে চলা তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে যদি তারা জয়ের সম্ভাবনা না দেখে, তখন তারা তাদের রাস্তা বদল করতে পারে। আর তাদের গ্রেটার প্ল্যান তো আমরা জানি না, কিছুটা অনুমান করা যায় বার্মা অ্যাক্টসহ নানা বিষয় মিলিয়ে। সেখানে বাংলাদেশও যদি অংশ হয়ে থাকে এবং তাদের সে পরিকল্পনা যদি কার্যকর হয়, তাহলে তারা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে পারে। তখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সরকারের জন্য সহজ হবে না।
ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিলেও রেমিট্যান্সের প্রবাহ আগের জায়গায় আনা কঠিন হবে। কারণ, লোপাট করা অর্থ তো যেকোনো মূল্যেই বাইরে পাঠাতে হবে। ডলারের দাম দেড় শ টাকা হয়ে গেলেও আরও ১০ টাকা বেশি দিয়ে কেনার লোক থাকবেন। এর ফলে অর্থনৈতিক দুরবস্থা বাড়বে। তবে যত দিন মধ্যবিত্ত মানুষ ভাতের ব্যবস্থা ও বাচ্চার টিউশন ফির টাকা জোগাড় করতে পারবেন, তত দিন তাঁরা রাস্তায় নামবেন না।
তাহলে সেই অর্থে সরকারের কোনো বড় বিপদ নেই বলছেন?
মুনীরুজ্জামান: এখানে সামনের চ্যালেঞ্জ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে, তথাকথিত ভারসাম্য রক্ষার সাফল্য সরকার কত দিন ধরে রাখতে পারবে। সামনের দিনগুলোতে ভারত ও চীনকে একসঙ্গে রাখা সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। চীনের রাষ্ট্রদূত গত সপ্তাহে বলেছেন, নির্বাচনের পরপরই তাঁরা তিস্তা প্রকল্প শুরু করতে চান। তিনি আশা করেন, বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে সহযোগিতা করবে। এখন ভারত তো তিস্তা প্রকল্পকে কোনোভাবেই গ্রহণ করবে না।
এ নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে অবস্থানে ফাটল ধরতে পারে। যা পরে অন্য ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হতে পারে। কাজেই চীন ও ভারতকে একসঙ্গে রেখে ভারসাম্য কূটনীতি রক্ষা করাটা সরকারের জন্য কঠিন হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যেটি দেখা যায়, তা হলো তারা তাদের স্বার্থে কোনো নীতি গ্রহণ করলে তা হঠাৎ করে পরিবর্তন করতে পারে না। এখন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাদের নীতি কী হবে, তা আরেকটু সময় নিয়ে দেখতে হবে। অন্তত আগামী ছয় মাস।
বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে ভূরাজনীতির বিষয়টি খুবই আলোচিত ছিল। আসলে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব কতটুকু?
তৌহিদ হোসেন: একসময় আমার মনে হতো, বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অত্যন্ত কম। চীনের সঙ্গেও যদি আমাদের সীমান্ত থাকত, তাহলে সেই গুরুত্ব বেশি থাকত। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি বিস্তৃত হওয়ার কারণে আমাদের গুরুত্ব বেড়েছে। আগে তাদের নজর ছিল শুধু প্রশান্ত মহাসাগরে। এখন ভারত মহাসাগরকে ঘিরেও তারা পরিকল্পনা করছে। এতটা নজর দিয়েছে যে তা ভারতকেও ভাবিয়ে তুলেছে।
ভারত মনে করে, এখানে সে মূল নিয়ন্ত্রক, যুক্তরাষ্ট্র বরং সেখানে সহায়তার ভূমিকা পালন করবে। ভারতের এমন ভাবনা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে না–ও মিলতে পারে। এ জন্য আমাদের গুরুত্ব এখানে বেশি। ভারত মহাসাগরের ঠিক ওপরের দিকে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার বাংলাদেশে থাকলে, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, তাদের জন্য একটি জায়গা থাকল। এখন এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক ফল নিয়ে এই ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আরও বাড়বে।
এ সরকারের আমলেও প্রথম ১০–১২ বছর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভালো অগ্রগতি হয়েছিল। দুই দেশের মধ্যে বহু চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে, বিশেষ করে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা উন্নয়নে। এখন নির্বাচনের পরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের সম্ভাবনা কি সরকারের পক্ষ থেকে দেখা যাবে?
তৌহিদ হোসেন: আসল প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত-চীনের অবস্থানের মধ্যে সরকার ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবে কি না। আমি মনে করি, সেটি সম্ভব হতে পারে। ধরা যাক, ভারত চাইবে না তিস্তা প্রকল্প নিয়ে চীন অগ্রসর হোক। চীন তো অবশ্যই সেটি করতে চাইবে। এখন সেই সুযোগ যদি চীন না–ও পায়, তাহলে কি তারা বাংলাদেশকে ছেড়ে চলে যাবে? আমার তেমনটি মনে হয় না। সোনাদিয়া নিয়ে কিছু করতে না পারলেও সম্পর্ক তো ঠিকই এগিয়েছে। চীন হয়তো একটু অসন্তুষ্ট হবে; কিন্তু মেনে নেবে এবং বাকিগুলোর দিকে তারা তখন গুরুত্ব দেবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের ক্ষেত্রে যেটি হওয়ার সম্ভাবনা, তা হচ্ছে তারা যদি সরকারের সঙ্গে সরাসরি বিরোধে না যায়, তাহলে সরকারের পক্ষে কিছু ছাড় দিয়ে তাদের সঙ্গে সম্পর্কটা ঠিক করে ফেলা সম্ভব। কারণ, সরকারও বুঝতে পারবে, সরাসরি সংঘাতে গেলে তার জন্য সমস্যা আরও বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্র নমনীয় হলে আমার মনে হয় সরকারও এগিয়ে আসবে।
সরকার বৃহৎ বৈদেশিক শক্তিগুলোর সঙ্গে ভালোই ভারসাম্য করে চলছে। এমনটি বলা হয়ে থাকে। বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে আপনাদের কাছে সরকারের জন্য দুটি পরামর্শ শুনতে চাই।
No comments:
Post a Comment